বাসাবাড়ির বারান্দা আর ছাদে ফুল, ফল ও সবজির পাশাপাশি ঢাকা শহরের অফিস-রেস্তোরাঁয়ও সৌন্দর্যবর্ধনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালি। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেও সবুজের প্রাধান্য থাকছে। শহরের মানুষের মধ্যে সবুজায়নের এ আগ্রহের কারণে নার্সারি ব্যবসা বাড়ছে। অনলাইন মাধ্যমেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্যবসাটি।
দেশে এ মুহূর্তে অনলাইনভিত্তিক নার্সারি ব্যবসার অন্যতম জনপ্রিয় নাম স্কাইফ্লোরা। তরুণ উদ্যোক্তা সাজিদ খানের হাতে গড়া এ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে বাগান তৈরির গাছ থেকে শুরু করে সব উপকরণ পাওয়া যায়। তারা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বাগান করতে সহায়তা করে। এখন পর্যন্ত স্কাইফ্লোরা ৩১ হাজার ছাদবাগান ও বারান্দায় বাগানের কাজ করেছে। গাছের চাহিদা বুঝে জৈব সার উৎপাদন করা হচ্ছে স্কাইফ্লোরার নিজস্ব কারখানায়। পরিবেশবান্ধব জিও ব্যাগও উৎপাদন করছে স্কাইফ্লোরা। গাছ ও বাগানসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের সুযোগও আছে স্কাইফ্লোরায়। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে কাজ করছেন ৪৭ জন কর্মী।
প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা সাজিদ খান বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই সবুজায়নের জন্য কাজ করছি। করোনাকালে শহরের মানুষের মধ্যে ছাদবাগান করার চাহিদা বেড়ে যায়। তখন আমরা ঢাকাসহ প্রায় ৩০ জেলায় ২ হাজার ছাদবাগান তৈরিতে সহায়তা করি। আমরা শুধু বাগানই তৈরি করে দিই না, পাশাপাশি বাগানের যত্নে যা দরকার, তার সব সেবা দিয়ে থাকি।’
গ্রাহকদের মানসম্মত সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে গত বছর কুষ্টিয়ার ত্রিমোহনীতে নিজস্ব সার কারখানা স্থাপন করেছে স্কাইফ্লোরা। সেখানে ‘আফ্রিকান ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ নামের পোকার মাধ্যমে অর্গানিক সার উৎপাদন করা হয়। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে উৎপাদিত এই সার প্রতি মাসে দেড় শ কৃষক সংগ্রহ করে তাঁদের নিজেদের ফসলের মাঠে ব্যবহার করছেন। এই সার দেশের প্রায় ছয় হাজার বাগানে প্রতি মাসে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সাজিদ খান জানান, মাটির গুণগত মান ও গাছের বৃদ্ধির জন্য এই সার দারুণ কার্যকর বলে ব্যক্তিপর্যায়ে ব্যবহারকারীদের আস্থা অর্জন করেছে। গ্রাহকদের কথা চিন্তা করে সাতটি নার্সারি স্থাপন করেছে স্কাইফ্লোরা। গ্রাহকের চাহিদা ও শহরের আবহাওয়া বিবেচনায় নিয়ে ৫৫০টি ল্যান্ডস্কেপের কাজ করেছে তারা।
৯ হাজার টাকায় শুরু
২০১৫ সালে মাত্র ৯ হাজার টাকা নিয়ে স্কাইফ্লোরা শুরু করেন সাজিদ খান। তিনি বলেন, ‘মা-বাবা ছোটবেলায় বাড়িতে বাগান করতেন। সে বাগানের জন্য বিভিন্ন নার্সারিতে যাওয়ার সুযোগ মিলত। তখন নার্সারি মানে বিশাল কিছু। মাটি, গাছ, সারসহ আরও কত কী! আবার সব নার্সারিতে সব গাছ পাওয়া যেত না। তখন চিন্তা করতাম, এক জায়গায় যদি সবকিছু পাওয়া যেত। আবার গাছপালার যত্ন নেওয়ার ঝক্কিও অনেক। এসব বিষয় মাথায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই কিছু একটা করার চেষ্টা করি।’
শুরুতে মিরপুর থেকে পুরো ঢাকায় গাছপালা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন সাজিদ খান। তিনি বলেন, ‘একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইনে কাজ শুরু করি আমরা। ফেসবুক পেজ থেকে অনলাইনে যোগাযোগ করে আমাদের কাছ থেকে প্রথম গাছ কেনেন মিরপুরের আবির আহমেদ। শুরুতে তিনটি গাছের ক্রয়াদেশ ছিল। আমরা ওই সময়ে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে গাছ সংগ্রহ করি। এরপর অনেক ক্রেতার জন্য গাছ সরবরাহ থেকে শুরু করে বাগান ব্যবস্থাপনায় কাজ করি। শুরুতে কয়েকটি বাগানের গাছ গ্রাহকের অযত্নে মারা গেলে আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করি। পরবর্তী সময়ে আমরা গার্ডেনিং সেবা বিস্তৃত করি।’
সারা দেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় ১৮ হাজার নার্সারি রয়েছে। বাংলাদেশ নার্সারি মালিক সমিতির হিসাবে, এ খাতেই কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। নার্সারিতে গেলেই তো গাছ কেনার সুযোগ আছে। ফলে নার্সারি ব্যবসায় প্রযুক্তির সংযোগের বিষয়টি কীভাবে মাথায় এল, এমন প্রশ্নের উত্তরে সাজিদ খান বলেন, ‘দেশে স্থানীয়ভাবে অনেক নার্সারি থাকলেও প্রযুক্তিনির্ভর বড় কোনো প্ল্যাটফর্ম ছিল না। বই, খাবার বা অন্য অনেক পণ্যের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম মানুষের মধ্যে ভালো সাড়া ফেলেছে। ফলে গাছ নিয়ে নতুন কিছু হতে পারে, সে চিন্তাভাবনা থেকেই আমরা অনলাইনে গাছসহ বাগানের বিভিন্ন উপকরণ বিক্রির উদ্যোগ নিই।’
ব্যবসা বাড়ছে
সবুজায়নে মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে। সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার বাড়ির মালিকেরা ছাদবাগান করলে হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপর ১০ শতাংশ ছাড় পেয়ে থাকেন। এ কারণে বড় শহরসহ উপজেলা পর্যায়েও গাছের চাহিদা বাড়ছে। সাজিদ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত মানুষের বাগান করার ধরন এক রকম, আবার উচ্চবিত্তের বাগান করার চাহিদা আরেক রকম। অন্যদিকে করপোরেট পর্যায়ে সবুজায়ন ও ছাদকৃষির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আমরা পুরো বৃক্ষরোপণকে একটি খাত হিসেবে চিন্তা করে কাজ করছি।’
সাজিদ খান আরও বলেন, ‘আমরা যেকোনো গ্রাহকের সমস্যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বাড়িতে গিয়ে সমাধানের সুযোগ রেখেছি। আবার কেউ যদি বৃক্ষরোপণ বা বাগানের বিষয়ে জানতে চান, শিখতে চান, সে ক্ষেত্রে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কার্যত ২৪ ঘণ্টাই জানার সুযোগ রেখেছি।’
এভাবেই স্কাইফ্লোরার ব্যবসা বাড়ছে। সাজিদ খান জানান, ২০১৫ সালে শুরুর দিকে তাঁদের বার্ষিক বিক্রি ছিল ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। এখন তাঁরা ১০-১২ কোটি টাকার পণ্য ও সেবা বিক্রি করছেন।