Blog Post

CNTV CTG > মতামত > ফিলিস্তিনি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যা যা হারিয়েছি

ফিলিস্তিনি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যা যা হারিয়েছি

এ বছরটি হৃদয় ভাঙার বছর। ভয়ের বছর। দোজখের মতো বছর। ‘এটি আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ বছর’—এ কথা যখন বলি, তখন আমি বুঝতে পারি, এটি শুধু আমার একার কথা নয়। 

এই বছরে আমি বন্ধু হারিয়েছি। রুটিরুজির সুযোগ হারিয়েছি। সবচেয়ে বেশি মূল্যবান যেটি হারিয়েছি, তা হলো মানবতার ওপর বিশ্বাস। কিন্তু আমার সব কথা বলার আগে নিজেকে একজন ভালো প্রবাসী ফিলিস্তিনি (যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া) প্রমাণ করতে আমাকে বাধ্যতামূলকভাবে যে মন্ত্রটি পড়তে হয়, সেটি আগে পড়ে নিতে দিন, ‘আমি হামাসকে নিন্দা করি, আমি হামাসকে নিন্দা করি, আমি হামাসকে নিন্দা করি।’ 

আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন, যতক্ষণ না কেউ আমাদের সহিংসতার নিন্দা জানাতে; বিশেষ করে হামাসের নিন্দা জানাতে বলে, ততক্ষণ সাধারণত আমাদের, অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের মুখ খোলার অনুমতি নেই। সেই একই ব্যক্তি যখন আমাদের ভাইয়ের হত্যার খবরে উল্লাস প্রকাশ করেন এবং অবিশ্বাস্যভাবে হত্যাকে উদ্‌যাপন করেন, তখন আমাদের মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়। তখন আমাদের একেবারে নীরব
থাকতে বলা হয়।

কোনো ইসরায়েলি যদি হত্যা করে, তাহলে সেটি হলো আত্মরক্ষামূলক কাজ। আর একজন আরব যদি কাউকে হত্যা করে, তাহলে তা হবে সন্ত্রাসী কাজ। এটাই এখানে নিয়ম। এটিই আমাদের মেনে নিতে হয়। এমনিতে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই আরবদের প্রতি তার ঘৃণা নিয়ে খুব একটা লুকোছাপা করেনি। কিন্তু ৭ অক্টোবরের পর থেকে এই ঘৃণা এমন ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে যে আমি এই দেশে এখন আর নিরাপদ বোধ করতে পারি না।  

আমি এ দেশে জীবন এবং পরিবার গড়ে না তুললে এখান থেকে চলে যেতাম। কেন আমি এমন একটি দেশে থাকতে চাইব, যেখানে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এতটাই অমানবিক আচরণ করা হয় যে সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম গাজায় (যেখানকার জনগণের অর্ধেকই শিশু) পারমাণবিক বোমা ফেলা উচিত বলে মন্তব্য করতে পারেন এবং এই ভয়ানক মন্তব্যের পরও তাঁকে অর্থবহ সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় না? আমি এমন দেশে কেন থাকতে চাইব, যেখানে আমার সিনেটর জন ফেটারম্যান ফিলিস্তিনপন্থী প্রতিবাদকারীদের প্রকাশ্যে উপহাস করেন এবং আমাদের দুর্দশা দেখে উল্লাস প্রকাশ করেন? 

তারপর আরও কথা আছে। আমি আমার রোজগারের অর্থ থেকে যে ট্যাক্স দিচ্ছি, তা আমারই ভাইবোনদের হত্যা করার ও তাদের না খাইয়ে মেরে ফেলার কাজে ব্যয় করা হচ্ছে। তাহলে আমি নিজেও কি পরোক্ষভাবে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে যুক্ত হচ্ছি না? 

আমি ক্রমেই এমন একটি দেশে বসবাস করার যুক্তি হারিয়ে ফেলছি, যেখানে আমাদের ট্যাক্সের একটি বড় অংশ যুদ্ধের তহবিল গঠনে ব্যয় হচ্ছে এবং যাঁদের পেছনে আমাদের রক্ত পানি করা ডলার খরচ করা হচ্ছে, তাঁদের কমলা হ্যারিস সারা মুখে আনন্দের ঝিলিক ছড়িয়ে ‘বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক যোদ্ধা বাহিনী’ বলে বর্ণনা করেছেন। 

৭ অক্টোবরের অনেক আগে থেকেই আমি এই ঘৃণার শিকার হয়েছি। বহুবার এখানকার মানুষ আমাকে বলেছে যে আমি ফিলিস্তিনি হতেই পারি না, কারণ ফিলিস্তিনিদের আদৌ নাকি অস্তিত্বই নেই। আমরা এখানে কতটা অমানবিক আচরণের শিকার হই, যা ভাবলে আমার দেহ অসাড় হয়ে আসে। কিছু মানুষের রক্তপিপাসা আমাকে স্তম্ভিত করে দেয়। 

হামাসের আক্রমণের সময় আমি গার্ডিয়ান–এ কলাম লেখা থেকে বিরতি নিয়েছিলাম। ওই সময় আমি একটি বড় বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে একটি করপোরেট কপিরাইটিংয়ের কাজ করছিলাম। ইসরায়েল হামলা শুরু করার পর এজেন্সিটির অভ্যন্তরীণ পরিসর গাজায় বোমাবর্ষণ সমর্থনকারীদের উল্লাসে ভরে যাচ্ছিল।

এজেন্সির কর্মকর্তাদের কাছে এ নিয়ে কিছু বলার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। আমি স্বীকার করছি, আমি রীতিমতো ভয় পাচ্ছিলাম। কারণ, একজন ফ্রিল্যান্স লেখক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন এবং আমি সাধারণত প্রতিবছর কয়েকটি করপোরেট কাজের ওপর নির্ভর করি। ভবিষ্যতে সুযোগ হারানোর ভয়ে আমি চুপ করে ছিলাম এবং বোমাবর্ষণ বন্ধ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। 

কিন্তু না। বোমাবর্ষণ আর বন্ধ হয়নি। নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়াল; এরপর ২০ হাজার ছাড়াল; এরপর ৩০ হাজার ছাড়াল; এরপর ৪০ হাজার ছাড়াল। এরপরও ইসরায়েলকে সন্তুষ্ট করার মতো মৃত ফিলিস্তিনির কোনো সংখ্যা সামনে এল না। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের মধ্যে এখনো কাউকে পাওয়া গেল না, যিনি বলবেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে, এবার থামো।’ 

একসময় আমি বোকার মতো ভাবতাম, কমলা হ্যারিসের উত্থান একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। কিন্তু পরে দেখলাম, তিনিও সেই একই গোয়ালের গরু। তিনি ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইসরায়েলকে নিঃশর্তভাবে অস্ত্র সরবরাহের নীতি থেকে সরবেন না। তিনি খোলাখুলিভাবেই আন্তর্জাতিক আইনকে স্বীকার করতে অস্বীকার করেছেন। 

গত আগস্টে যখন কমলার মাথায় ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়, তখন দলটির নেতারা এক মিনিটের জন্যও কোনো ফিলিস্তিনি-আমেরিকানকে মূল মঞ্চে ডাকেননি। 

গাজায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। এখন লেবাননের মানবিক পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে উঠেছে। এসব নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক উভয় শিবিরের রাজনীতিবিদেরা বলে চলেছেন, আমাদের আজকের দুর্দশার জন্য নাকি আমরাই দায়ী।  

আসুন মনে করে দেখি, আজকের এই পরিস্থিতির শুরুটা কোথায় ছিল: ৭ অক্টোবর। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে কমলা হ্যারিস এই লাইনটি উল্লেখ করেছিলেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী টিম ওয়ালজ ও তাঁর প্রতিপক্ষ জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে বিতর্কে এই লাইনটি বারবার বলা হয়েছে।

কিন্তু লাইনটি একটি মিথ্যা বয়ান তৈরি করছে। কারণ, ইতিহাস ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হয়নি। এই তারিখটি যদিও ইসরায়েলের জন্য একটি বিপর্যয়কে চিহ্নিত করতে পারে, তবে আসল সত্য হলো, ৭৬ বছর ধরে প্রতিটি দিনই ফিলিস্তিনিদের ওপর কিছু না কিছু বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। 

ইতিহাস ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হয়নি। কিন্তু বিশ্ব যখন দিনটিকে স্মরণ করার জন্য থমকে যায়, তখন বোঝা যায়, বিশ্বের কাছে কাদের জীবনের মূল্য আছে, আর কাদের জীবন মূল্যহীন। 

 আরওয়া মাহদাওয়ি গার্ডিয়ান–এর একজন কলামিস্ট

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *