শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে তাঁর সাম্রাজ্য বিবেচনা করে গত সাড়ে ১৫ বছরে নির্বিচার লুটপাট করে গেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কৃপায় ভারতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। ওই সময় তাঁদের দিল্লিতে অত্যন্ত সাধারণ মানের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে হয়েছিল।
১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। আশির দশকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্বৈরাচার এরশাদের কাছ থেকে আর্থিক উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল।
১৯৯৬-২০০১ ক্ষমতার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রধান নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয়ের জন্য দুর্নীতিকেই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু ২০০১-০৬ মেয়াদে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বেলাগাম দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের লুটপাট ও প্যারালাল সরকার পরিচালনা, জামায়াতের জঙ্গি লালন, বাংলা ভাইয়ের তাণ্ডব, জেএমবির সন্ত্রাস ও বোমাবাজি, ২০০৪ সালের ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার এবং সর্বোপরি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ নেতা-কর্মীকে হত্যা ও ২০০৫ সালের আগস্টে ৬৩টি জেলায় বোমাবাজি, ২০০৬ সালের শেষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের পরাজয়কে অবধারিত করে তুলেছিল।
এরপর, ২০০৬-০৭ সালের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপশাসন ও নির্লজ্জ বিএনপি-তোষণ এবং সবশেষে ২০০৭ সালের ১/১১-এর সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ রাজনীতির পটপরিবর্তনের প্রধান অনুঘটক হয়ে ওঠে।
এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভূমিধস বিজয় অর্জন করতে সমর্থ হয়। ওই ভূমিধস বিজয় হাসিনাকে হয়তো আজীবন প্রধানমন্ত্রীর মসনদ দখল করে রাখার সর্বনাশা খায়েশে মত্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি একতরফা নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতার মসনদকে পাকাপোক্ত করার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন হাসিনা। এই তিন একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ বরবাদ করে দিয়ে শেখ হাসিনাই গণ-অভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতকে ডেকে এনেছেন।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই হাসিনা দেশটাকে তাঁর সাম্রাজ্য হিসেবে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করার মিশনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা, তাঁর আত্মীয়স্বজন ও তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী-ধনকুবেররা। প্রধানত উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পুঁজি লুণ্ঠনকে হাসিনা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। হাসিনা তাঁর সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ মাধ্যমে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলিগার্কি-ব্যবসায়ী ও পুঁজি-লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তার ভয়াবহ কাহিনি তাঁর পতনের পর উদ্ঘাটিত হতে শুরু করেছে।
৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের দাবি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এর মানে এই দুটি ঋণের স্থিতির অঙ্কের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বিশাল ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন; যাকে এককথায় বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও জনগণের সঙ্গে ভয়ানক প্রতারণা। ফলে প্রতিজন বাংলাদেশির মাথার ওপর এক লাখ টাকার বেশি ঋণের বোঝা নিজেদের অজান্তেই চেপে বসে গেছে।
হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লাখ লাখ কোটি টাকা, যে জন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর এই পুঁজি লুণ্ঠনের কেন্দ্রে ছিলেন হাসিনাপুত্র জয়, রেহানাপুত্র ববি, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল, তাঁর ভাই শেখ জুয়েল ও তাঁর ছেলে শেখ তন্ময়, সেরনিয়াবাত হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ, শেখ তাপস, শেখ পরশ, লিটন চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরী এবং হাসিনার অন্য আত্মীয়স্বজন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজ অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদের দুই হাতে টাকা কামাতে হবে।’ প্রতিমন্ত্রিত্ব গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রকৃতপক্ষে সরকারের সবকিছু পরিচালনা করছিল হাসিনার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা শুধুই শিখণ্ডী। চরমভাবে হতাশ হয়ে ২০০৯ সালের মে মাসে সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
সম্প্রতি একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প দাবি করেছে যে শেখ হাসিনা তাঁর ছেলে জয় এবং শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপের মধ্যস্থতায় এবং একটি মালয়েশিয়ান ব্যাংকের সহায়তায় রূপপুর প্রকল্প থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছেন।
প্রথম আলোর এক খবরে জানা যাচ্ছে, দেশের চলমান ৮২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোনো না কোনো আত্মীয়স্বজন জড়িত রয়েছেন, যেগুলোর প্রকল্প ব্যয় ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ তাপস মধুমতি ব্যাংকের লাইসেন্স পেয়েছেন, আরেক আত্মীয় আকরামউদ্দিন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের লাইসেন্স বাগিয়েছেন। আরেক আত্মীয় তাকসিম খান ঢাকা ওয়াসাকে লুটেপুটে খেয়েছেন ১৫ বছর। গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ার সুবাদে বেনজীর আহমেদ পুলিশে রাজত্ব চালিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। শেখ রেহানার দেবর তারেক সিদ্দিক সেনাবাহিনীতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে রেখেছিলেন।
এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে হাসিনার পতনের পর গত দুই মাসে তাঁর একজন আত্মীয়ও পুলিশের কাছে ধরা পড়েনি, সবাই যথাসময়ে দেশ থেকে ভেগে যেতে পেরেছেন। তাঁদের সবাই কোটিপতি হয়ে গেছেন, সবারই বিদেশে হয়তো বাড়িঘর রয়েছে কিংবা নাগরিকত্ব রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের যেখানেই তাঁদের বাড়িঘর ও ব্যবসা ছিল, সব হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, নয়তো লুটতরাজ ও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। এ সত্ত্বেও গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশ থেকে বিদেশে যে পরিমাণ অর্থ তাঁরা পাচার করেছেন, তা দিয়ে বাকি জীবন বিদেশে আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দেবেন তাঁরা। আফসোস হচ্ছে, তাঁরা যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে ভেগে যেতে পেরেছেন, সে অর্থ দেশের জনগণ হয়তো কখনোই ফেরত পাবেন না।